পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪

শঙ্খচূড়-


(উপন্যাসটা শুরুর আগেই বলে নিচ্ছি এটার একটা ভূমিকা আছে। মোটামুটি একটা চ্যাপ্টার তুল্য ভূমিকা। যদিও এটাকে আমি চ্যাপ্টারের শ্রেণীতে ফেলতে রাজি নই।)

পূর্বকথাঃ 
আজ হাজী বাড়ির ভেতরে বাহিরে উপচে পড়া ভিড়। বহুকাল এত মানুষের সমাগম হয়নি মাঝারি সীমানার এ বাড়িতে। কুয়া পাড়েও জনা ছয়েক মানুষ পাঞ্জাবী পাজামা পরে এদিক ওদিক বিমর্ষ মুখে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে, দেখে বোঝা যাচ্ছে কোথাও বসার জন্য চেয়ার খুঁজছে- কিংবা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না এখানে থাকবে নাকি বাহিরে বেরিয়ে কোথাও থেকে দুকাপ চা, সাথে বিড়ি সিগারেট টেনে আসবে। কারণ এ বাড়িতে আজ খাওয়া দাওয়া হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অন্তত চুলা ধরবে না একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগ পর্যন্ত।
উঠানের কিশোর বয়সী ঝুলে পড়া আম গাছটার চারপাশে প্লাস্টিকের চেয়ার এদিক সেদিক বিছিয়ে রাখা। একটাও খালি নেই। গেদা বাচ্চা থেকে শুরু করে থুড়থুড়ে বুড়ো দিয়ে চেয়ার গুলো ভরে গেছে।
উঠানের একপাশে সিমেন্টের ছাদ খোলা গোসল খানার ওপরে ছাদের মত বিছিয়ে মেলে ধরা জাম্বুরা গাছটায় ঝুলতে থাকা পাঁকা জাম্বুরাগুলো কিংবা কুয়াপাড়ের শিমুল গাছটার কড়া মিষ্টি গন্ধগুলো ছাপিয়ে যাচ্ছে তীব্র ধূপ কাঠি আর আগর বাতির গন্ধ। সাথে যোগ হয়েছে আতর গোলাবের মিষ্টি সুঘ্রাণ। সারা বাড়িতে মাজার মাজার ভাব এনে দিয়েছে ঘ্রাণটা। সবাই কথা বলছে নিচু স্বরে, যেন উচ্চ স্বরে কথা বললেই চারপাশের নিরেট থমথমে গুমোট ভাবটা কাঁচের মত ভেঙ্গে পড়বে। নিচু গলায় মেয়েলি স্বরে কেউ কাঁদছে, বোঝা যাচ্ছে না কে কোথায় কাঁদছে, কেবল ফোঁপানোর শব্দটুকুই জানান দিচ্ছে কান্নার। মাঝে মাঝে সব ছাঁপিয়ে জোরে কেউ কেউ কেঁদে ওঠে।
দু চারটে করে দেখতে দেখতে বাড়ির বাহিরে সুপারি বাগানের নিচে বিশ ত্রিশটা মোটর সাইকেল আর মাইক্রোবাস এসে জমাট হয়েছে। মেয়েরা ব্যস্ত ভঙ্গিতে চোখে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে গিয়ে ঢুকছে। পুরুষ লোকেরা অস্বস্তি ভরে আশে পাশের লোক জনের দিকে তাকাতে তাকাতে উঠানে ঢুকছে। পরিচিত কাউকে দেখা পাবার আশায় এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। পরিচিত তেমন কাউকে না পেলে এগিয়ে যাচ্ছে উঠানের মাঝখানে রাখা উত্তর দক্ষিণ মুখ করে রাখা খাটিয়াটার দিকে। কাবা ঘরের ছবি আর কালেমা লেখা সবুজ জমিনের একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। আগর বাতির তীব্র গন্ধ যেন কুন্ডলী পাঁকিয়ে ঘিরে রয়েছে খাটিয়াটাকে। সাদা দামী একটা কাফনের কাপড়ে শুয়ে আছেন ডি.এম. খায়রুল আনাম। আল্প খানেক ফাঁক দিয়ে দর্শনার্থীরা তাঁর মুখটা দেখতে পাচ্ছে। একটু পরপর লাশের কাছে বসে থাকা একটা লাল পাঞ্জাবী পরা তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সী ছেলে রুমাল দিয়ে লাশের মুখ থেকে গড়িয়ে পড়া কালো-সাদাটে রস মুছে পরিষ্কার করে দিচ্ছে ক্লান্ত ভঙ্গিতে। কাফনের অল্প খানেক খোলা মুখ দিয়ে আকাশটা দেখা যায় আম গাছের পাতার ফাঁক গুলো দিয়ে। কিন্তু ডি.এম. খায়রুল আনাম সাহেব চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি চাপা ভাব নিয়ে পশ্চিম মুখো হয়ে ঘুমিয়ে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে সন্তান সন্ততি আর নাতি-নাতনিদের বেয়াড়াপনায় মহা বিরক্ত মাষ্টার সাহেব শীতের দুপুরে খাবার খেয়ে চোখ বুজে শুয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করছেন। নাতি-নাতনিরা ঘুমের চেষ্টারত মাষ্টার সাহেবকে ডাকলেই বুঝি চরম বিরক্তি নিয়ে ধমকে উঠবেন এখনি! চোখ মেলে তাকাবেন যেন!
বিরক্তি নিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত ডি.এম. খায়রুল আনামের সদ্য বিধবা ষাটোর্ধ স্ত্রী তহমিনা বেগম ভেতরের ঘরে স্বামীর বিছানার পাশের নিজের বিছানায় লাল লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছেন। চুপচাপ। ঝিমুচ্ছেন যেন। তাকে ঘিরে তাঁর ছয় মেয়ে পিতা হারানোর কান্নায় মেঝে চৌচির করে কাঁদা শুরু করেছে সেই সকাল বেলা আসার পর থেকে। বাবা মারা যাবার কথা শুনে দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খায়রুল আনাম সাহেবের ছোট ছয় মেয়ে তাদের স্বামী-সন্তান নিয়ে ছুটে এসেছেন। নাত জামাই এবং তাদের সন্তানরাও বাদ যায়নি। বড় ছেলে গুলো এখনো আসেনি, কেবল একজন আছে। বাকি দুজন এখনো রাস্তায়। বাসে করে ঢাকা থেকে আসতে সময় লাগে।
বহু বছরের নিষ্প্রাণ হাজী বাড়ির পুরো দেহটায় যেন আজ প্রাণ জেগেছে একয়াত প্রাণের বিদায় জানিয়ে। তহমিনা বেগম শুয়ে শুয়ে এত ভিড়ের মাঝে পাশের বিছানাটা দেখবার চেষ্টা করছেন। খায়রুল আনাম সাহেবের এই বিছানাটা বিয়ের সময় তহমিনা বেগমের বাবা দিয়েছিলেন। খায়রুল সাহেব ঐ বিছানা ছাড়া কিছুতেই ঘুমাতে পারেন না। তহমিনা বেগমের অবাক লাগছে কেন জানি, হিসাব মেলাতে পারছেন না। এত কালের ঘুমের খাট বিষয়ক অভ্যাসটা এক মুহূর্তেই বদলে ফেলে তাঁর স্বামী বাহিরের উঠানের ঐ খাঁটিয়ায় কি করছেন তিনি বুঝতে পারছেন না। দূর্বল গলায় বার কয়েক বলার চেষ্টা করলেন সবাইকে, “এই তোরা কান্না থামা তো! তোদের আব্বাকে বল বিছানায় আসে ঘুমাইতে, এত শীতে বাহিরে কি করে? ওনাকে বল বিছানায় ছারপোঁকা নাই। আমি কেরাসিন দিছিলাম পরশুই। যা ওনাকে ভিতরে আসতে বল।”
আশ্চর্য ব্যাপার! কেউ শুনতেই পাচ্ছে না তহমিনা বেগমের কথা।  পাগল হয়ে গেল নাকি সবাই? গত রাতে বাথরুম থেকে ফেরার পর তহমিনা বেগম স্বামীকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে গিয়েছিলেন। কত কয়েক বছর ধরে মাঝ রাতে এসে স্বামীকে নেড়ে দেখেন। কফ জমে কয়েকবার নিউমোনিয়া বাধিয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছিল খায়রুল সাহেবের। তখন থেকেই মাঝ রাতে তাঁকে নেড়ে চেড়ে দেখেন ঠিক মত শ্বাস নিতে পারছেন নাকি। সে রাতেও  স্বামীর হাত ধরে নেড়ে দিচ্ছিলেন। আগের সারা দিন অসুস্থ ছিলেন কিনা, ইদানীং প্রায়ই ঠান্ডা লাগে তাঁর। তহমিনা বেগম হাত ঝাঁকি দিয়ে অনুভব করলেন হাতটা যেন অসম্ভব শীতল। একটু অবাক হয়ে ডাকতে লাগলেন সেই মাঝ রাতে, “এই, উঠো? কি হইছে? খারাপ লাগতেছে?”
খায়রুল সাহেব বোধ হয় তহমিনা বেগমের ডাকটা তখন শুনতে পাননি। পেলে গত বাহান্ন বছরের প্রত্যেকটা রাতের মত জেগে উঠতেন। পাতলা ঘুম ওনার, আজ যে কোথা থেকে এত ঘুম চাপল ওনার- ভেবে পাচ্ছেন না তহমিনা বেগম।

ডি.এম. খায়রুল আনামের মোটামুটি বিশাল পরিবার। তাঁর বড় তিন ছেলে এবং ছয় মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে সেই পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগেই। সবার স্বামী সংসার আছে। তিন ছেলের মাঝে ছোট ছেলের সাথে থাকেন তিনি ও তাঁর স্ত্রী। ছোট ছেলের নাম মুকূল। মুকূলেরও বিরাট সংসার। বাকি দুই ছেলে থাকে বীরগঞ্জ আর ঢাকায়। ঢাকায় থাকে বড় ছেলে। বাবা মারা গেছে শুনে দেখতে আসছে সে। বাসে এখনো, আসতে আসতে বিকেল গড়াবে। বাবার মুখ শেষ বারের মত দেখবে তাই জানাযা আর দাফনের পর্বটা মাগরীবের পর করা হবে। এখনো অনেকের আসা বাকি।
পঞ্চগড় বি.জি.বি. ব্যারাকের সামনের খোলা পাড়া নামের ছোট্ট এই গ্রামে আজ হাজারো মানুষের ভিড়। একটা মানুষের জন্য ঝিমিয়ে থাকা এ গ্রামে আজ এতটা প্রাণ চাঞ্চল্য। মাঝ বয়সী থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যায়ের মানুষগুলো হাল্কা রঙের কাপড় পরে দেখতে এসেছে শেষ বারের মত মাষ্টার সাহেবকে। কম বয়সী ছেলে মেয়েরা কিছুটা রন-চঙ্গের পোশাক পরে এসে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে আর মোবাইলে নিজেদের ছবি তুলছে।
লোকজনের ভিড়ের কারণে খাঁটিয়া এখন বাড়ির বারান্দায় তুলে আনা হয়েছে। একটা স্ট্যান্ড লাগানো ফ্যান দিয়ে বাতাস দেয়া হচ্ছে লাশের ওপর। এত শীতের মাঝে ফ্যান কেন লাগিয়েছে বোঝা গেল না। পাশে মাদুর বিছিয়ে লাশের মাথার কাছে একটা মেয়ে কোরআন তেলাওয়াত করে যাচ্ছে সেই সকাল থেকে। ক্লান্তিহীন কোরআন তেলাওয়াতের একয়াত সুরে হাজী বাড়ির বাতাস ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। যেন জানান দিচ্ছে কারো চির বিদায়ের।
মেজ ছেলে তহমিদার ইসলাম এসে বাবার মুখখানা একবার দেখে গেলেন। আজ কাঁদার সময় নেই ছেলেদের। হাতে কত কাজ বাকি। বাড়ি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে দেড় কিলোমিটার খানেক দূরে খাপোগড়ি গোরস্থান। একপাশে ডি.এম. পরিবারের পারিবারিক গোরস্থান আলাদা করা। বিরাট বট গাছের একপাশে খায়রুল সাহেবের চির নিদ্রার শায়ন কক্ষ তৈরি করা হচ্ছে। মেজ ছেলে সেখানে গিয়ে কাজে হাত লাগালেন। আরো কয়েকজন কাঁচা বাঁশ কেটে “হেরাং” বানিয়ে কবরের মুখ বন্ধ করার আয়োজন করছে। কেউ কেউ বেড়া বানাচ্ছে। আবার কেউ জেনারেটর দিয়ে রাতে দাফনের সময় আলোর ব্যবস্থা পাঁকা করছে।
আজ মহররম। শুক্রবার। একটু পরেই জুমার আযান দিবে। মাষ্টার সাহেব ভাল দিন দেখে বিদায় নিয়েছেন- কবর খুঁড়তে খুড়তে লোকজন বলা বলি করছে।
বাড়িতে যারা দূর থেকে এসেছে, তাদের খিদে পেলেও বলতে পারছে না। তাই আশে পাশের বাড়িগুলো থেকে লোকজন এসে তাদের একরকম জোর করে নিয়ে যাচ্ছে, খেতে দিচ্ছে। এখানের নিয়ম অন্য রকম। লাশ বাড়ি থেকে বের হলে সাথে সাথে চুলা ধরাতে হয়, নয়তো পরের তিন দিন চুলা জ্বলবে না। তাই অন্তত সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত এবাড়িতে খাবার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
দুপুরে জুমার সময় দেখা গেল খোলা পাড়ার ছোট মসজিদের উঠান পর্যন্ত উপচে পড়া মানুষের ভিড়।মাষ্টার সাহেবের মৃত্যুতে সবার যেন পরকাল বিষয়ক টনক নড়েছে। জীবনেও মসজিদ মুখো হন না- এমন মানুষও আজ এসেছে।
খায়রুল মাষ্টারের চাচাতো ভাই রশীদ সাহেব গম্ভীর মুখে জামাইদের সাথে কথা বলছেন মসজিদের এক কোনায় নিচু স্বরে।
“চাচা, আপনার আব্বা এলেন না আজ?” বড় জামাইয়ের প্রশ্ন।
“আর আসা! খোলাপাড়ায় আজরাইল ঢুকছে এই ভয়ে আজকেই চলে যাবে। খালি দাফনটা হোক।” রশীদ সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন। রশীদ সাহেবের বাবা হাফিজ মেম্বার এই গোটা পরিবারের বেঁচে থাকা সব চেয়ে বড় এবং বয়স্ক মানুষ। একশোর ওপর বয়স তাঁর। তাঁর চাচাতো বড় ভাইয়ের ছেলে খায়রুল আনাম মাষ্টার। ভাতিজার মৃত্যুতে ভয় পেয়েছেন তিনি। সকালে উঠেই এলাকা ছাড়ার তোড় জোড় শুরু করে দিয়েছিলেন। সবাই বুঝিয়ে সুঝিয়ে থামিয়েছেন তাঁকে। দাফন হোক- তারপর যাওয়া যাবে। এখনো মসজিদে আসেন নি দেখে জামাইরা এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। একটু পর অবশ্য এলেন। বয়সের ভারে নুয়ে পরেছেন। লাঠিতে ভর করে চলতে হয়। নাত জামাইদের দেখে বলে উঠলেন, “চইলা যামুরে, চইলা যামু। খোলাপাড়ায় আজরাইল ঢুকছে। যামু গা। নাইলে আমারেও খাইবো!”
কেউ প্রত্যুত্তরে কোনো কথা বলল না। রাগী স্বভাবের এই বুড়োর সাথে কথা বলতে যাওয়া মানে কথার ডাল পালা গজানো। দরকার কি?

জুমার পরে দিনটা যেন খুব দ্রুত ফুরিয়ে গেল। সব ছেলেরা এসে গেছে। মাগরীবের নামাযের পর রীতিমত কান্নার রোল পরে গেল হাজী বাড়ি সহ খোলাপাড়া গ্রামে। লাশ বাড়ি থেকে বের করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে মানুষের ভিড় আর ছয় মেয়ের গগণ বিদারী বুকফাটা আর্তনাদে। চুলা জ্বলছে এখন।

লাশটা স্কুল মাঠের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওখানে জানাযা পড়ানো হবে।

তহমিনা বেগম ধীর পায়ে হেটে বারান্দায় এসে বেঞ্চে বসলেন। ক্লান্ত লাগছে খুব তাঁকে। কারেন্ট চলে গেল।সবাই এদিক ওদিক ছোটা ছুটি শুরু করেছে আলোর জন্য। মরা বাড়িতে আলো থাকতে হয় চল্লিশদিন। লাশের যাওয়ার সাথে সাথে আলো চলে গেলে অমঙ্গল। এমনিতেই খায়রুল সাহেব মারা গেছেন হাতের মুঠো বন্ধ করে। হাতের মুঠো বন্ধ করে মারা গেলে নাকি বাড়ির সব রিযিক-বরকত চলে যায় মৃতের সাথে সাথে।
আলোর জন্য ছুটতে থাকা মানুষগুলোর তহমিনা বেগমের প্রতি ভ্রুক্ষেপ নেই।
তিনি চোখ পিটপিট করে চারিদিকে তাকাচ্ছেন। দূরে কুয়াশার মাঝদিয়ে কুয়া পাড়টা দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলো আম গাছের পাতা দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে এসে কুয়াপাড়টা ভিজিয়ে দিচ্ছে যেন......
তহমিনা বেগমের ঠিক মনে পরছে না- কাকে সর্ব প্রথম এই কুয়াটায় গোসল করতে দেখেছিলেন? তাঁর স্বামী? নাকি হাজী খামিরুদ্দিন সাহেব, তাঁর শ্বশুড়? কেউ কি ডুবে মরেছিল এখানে? কৈ? মনে তো পরছে না....... তাহলে কেন লাগছে কেউ ডুবে মরেছিল এই কুয়াতে? নাহ! এ কুয়া না। এটা তো মুকূলের জন্মের সময় খোঁড়া হয়েছিল। অন্য কোনো কুয়াতে হবে। কিন্তু ঐ কুয়াটা কোথায়? বন্ধ করে দিয়েছে নাকি কেউ?
তহমিনা বেগম কাঁপা হাতে নাকে হাত দিলেন, দীর্ঘ বায়ান্নটা বছর একটা নাঁক ফুলে কাটিয়েছিলেন, সেটা আজ খুলে নিয়েছে বৌমা’রা। কেমন যেন খালি খালি লাগছে।
তহমিনা বেগমের স্মৃতি বিস্মরণ হচ্ছে। সঙ্গে দৃষ্টি বিভ্রম। লাগছে উঠানটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। আশেপাশের পাকা বাড়ি গুলো মিলিয়ে যাচ্ছে, উঠানের চারপাশ ঘিরে মাটি ফুঁড়ে গজিয়ে উঠছে আকাশ ছোঁয়া কাঁঠাল গাছ, আম গাছ...... কুয়াপাড়টার পাশে গজিয়ে উঠেছে বিরাট এক নারকেল গাছ..... তিনি অর্ধেক পাঁকা, আর টিনের দেয়াল দেয়া টিন সেডের একটা বাড়ির বারান্দায় বসে আছন...... সীমানাটা বাঁশের উঁচু চাটাইয়ের বেড়ায় ঘেরা....
তহমিনা বেগম ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনি শুনলেন। চমকে উঠলেন, আপনা আপনি মাথায় ঘোমটা’টা ভাল করে টেনে নিলেন......তাঁর শ্বশুড় হাজী খামিরুদ্দিন সাহবে তাঁর ঘোড়ায় চেপে হাট থেকে ফিরল বোধ হয়! অবাক হয়ে দেখলেন বাড়ির তিন দিক থেকে দরজা, রান্নাঘর আর গোয়াল ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন তাঁর তিন শ্বাশুড়ি আম্মা..... হাজী সাহেব গেট দিয়ে ঢুকবেন, অথচ আলো যে কোথায়! রাগ লাগছে তহমিনা বেগমের। উঠে দাঁড়ালেন, নিজেই আলো আনতে রওয়ানা হলেন। শ্বশুড় আব্বা এসে সব অন্ধকার পেলে বাড়িঘর মাথায় করে ফেলবেন। ওনার রাগ ভয়ংকর রাগ।
হারিকেনটা যে কোথায় রেখেছে তাজলের মা। হাতড়ে বেরাচ্ছেন তহমিনা বেগম। একবারও মনে পরছে না তাজলের মা বলে কেউ নেই এখন আর। পঞ্চাশ বছর আগেই মারা গেছেন। কাঁপা স্বরে ডেকে যাচ্ছেন, “তাজলের মা, তাজলের মা? হারিকেনটা কোথায় রাখলা? আব্বা আসছে তো!”


সোঁনাহার গ্রামটা মোটামুটি বিশাল। তহমিনা বেগমের জন্ম এখানেই। বিরাট ধনী পরিবারে জন্ম। বাড়ির প্রধান মতিয়ার রহমান। মতিয়ার রহমানের প্রথম পক্ষের ঘরে জন্ম তহমিনা বেগমের। সাত বোন আর দুই ভাই। যদিও তিনি মানুষ হয়েছিলেন মতিয়ার রহমানের ছোট ভাই এনায়েত রহমানের ঘরে। নিঃসন্তান এনায়েত রহমান বড় ভাইয়ের কাছে একটা সন্তানের জন্য হাত পেতেছিলেন। ফেরাতে পারেননি তিনি। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর ভবিষ্যত সন্তান ছেলে হোক কি মেয়ে হোক- ছোট ভাইকে দেবেন কথা দিয়েছিলেন। কথা রেখেছিলেন তিনি।
তহমিনা বেগম ছোটবেলা থেকেই জানতেন বড় চাচাই তাঁর প্রকৃত বাবা, কিন্তু এনায়েত সাহেবের পিতৃস্নেহ তাঁকে সারাক্ষণ মুগ্ধ করে রাখতো। পাশাপাশি ঘরের এক ছাদের নিচে সব ভাই বোন গুলো মানুষ হয়েছিল। এনায়েত সাহেব তহমিনা বেগমকে অনেক পড়িয়েছিলেন। ঘরে রেখে মাওলানা, পন্ডিত দিয়ে পড়াশোনা করাতেন। মাদ্রাসাতেও ভর্তি করে দিয়েছিলেন। দেখতে দেখতে তেরোটি বছর পার করার পর তহমিনা বেগমের বিয়ের প্রস্তাব আসে উররতের বহুদূর এক গ্রাম থেকে। খোলাপাড়া নামের এক গ্রামের হাজী পরিবারের বড় ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়। ছেলের নাম ডি.এম. খায়রুল আনাম।
“শঙ্খচূড়” উপন্যাসের মূল গল্প এখান থেকেই শুরু হয়।


আজ সোমবার। সোঁনাহার গঞ্জে হাটবার। দূর দূরান্ত থেকে লোকজন জিনিষপত্র নিয়ে এসেছে ভাল দামে বিক্রি করার জন্য। দেবীগঞ্জের নদীপথে অনেক বজরায় করে বাহিরের বণিকরা নানা রকমের পণ্য এনেছে কেনা বেচা করতে। সোঁনাহার আর দেবীগঞ্জ পাশাপাশি গ্রাম। হাটটা হয় ঠিক মাঝামাঝি করতোয়া নদীর পাড়ের বিশাল বাজারটায়। হাট বারের একদিন আগে থেকেই নানান সার্কাস দল, লেটো গানের দল, যাত্রাদল এসে ভিড় করে নদীর পাশের ময়দানে। জাদুঘড়ি নামের এ ময়দানে একদিনের জন্য রীতিমত মেলা বসে সপ্তাহে। বায়োস্কোপের দলও আসে। সোমবার দিন-রাত লোকজনে পুরো করতোয়া নদীর ঘাটে রমরমা অবস্থা। মতিয়ার রহমানের দু-চারটা বজারা এখানে প্রত্যেক হাটেই হাজির থাকে মালপত্র নিয়ে। বিরাট বিছানো ব্যাবসা তাঁর এবং তাঁর ছোট ভাই এনায়েত রহমানের। দেবীগঞ্জে বিসাল কারবার তাঁদের। দূর দূর দেশ থেকে নানা রকম মাল পত্র কম দামে কিনে এনে চড়া দামে বিক্রি করেন এখানে। অন্যান্য জায়গাতেও মালপত্র পাঠান।
আজকের হাটেও অন্যান্য দিনের মত এসেছেন মতিয়ার রহমান। সঙ্গে ছোট ভাই এনায়েত রহমান এবং হিসাব রক্ষক ফযর আলী। নদীর পাড়ে বজরার মালপত্রের হিসাব দেখে সবে বাজারের দিকে পা বাড়াবেন মতিয়ার রহমান, হঠাৎ থমকে গেলেন। একটু অবাক হয়ে তীরে দাঁড়ানো আরেকটা বজরার দিকে তাকালেন। নদীর ঘাটের আর সব বজরা গুলোর থেকেও প্রায় দ্বিগুণ বড় একটা বজরার ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন সাদা পাঞ্জাবী আর পাগড়ি পরা এক ভদ্রলোক। পঞ্চাশের ওপর বয়স হবে আনুমানিক। হাতে খুব দামী কাঠের কারুকাজ খোদাই করা একটা কালো ছড়ি। ভদ্রলোককে খুব চেনা চেনা লাগছে মতিয়ার রহমানের। চোখ পিটপিট করে বার কয়েক তাকালেন দূরে দাঁড়ানো সেই ভদ্রলোকের দিকে। আস্তে আস্তে হাসি ফুটে উঠল মতিয়ার রহমানের মুখে, “তোরা এখানে দাঁড়া। আমি একটু আসতেছি।” বলে হন হন করে হাটা ধরলেন সেই বজরার দিকে।
নদীর ঘাটে প্রচুর কাঁদা, হাটতে গেলেই খরম দেবে যায়। টেনে তোলাই যায় না, মাঝে মাঝে খরম বিসর্জন দিতে হয় নদীর ঘাটের কাঁদার পেটে। মতিয়ার রহমানের হাটতে সামান্য কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু পাত্তা দিলেন না। সেই বজরাটার কাছে পৌছেই হাক দিলেন, “আসসালামুয়ালাইকুম হাজী সাহেব! আছেন কেমন?”
ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক মতিয়ার রহমানকে দেখে ভীষণ অবাক হলেন, “আরে কি কান্ড! মতিয়ার সাহেব আপনে এখানে! ওয়ালাইকুম সালাম! আসেন আসেন, ওপরে উঠে আসেন। ঐ কে আছিস? মই নামায় দে।”
সাথে সাথে হন্ত দন্ত হয়ে দুজন লোক ছুটে এল। কাঠের বিশাল খাঁজ কাটা লম্বা মইয়ের মত তক্তা নামিয়ে দিল। মতিয়ার রহমান উঠে এলেন। হাজী সাহেব তাঁকে দু হাতে জড়িয়ে ধরলেন, “আল্লাহ পাকের অশেষ মেহেরবাণী! এখানে এসে যে আপনাকে পায়ে যাবো- ভাবতেই পারি নাই!”
মতিয়ার রহমান আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে বললেন, “আমিও তো! আপনি যে এখানে আসবেন আগে জানলে কখন আসে হাঁড়ায় থাকতাম! হঠাৎ দেবীগঞ্জে যে আপনি? কেনা বেচা নাকি? আপনেও শেষ পর্যন্ত বনেদী ব্যবসা ধরলেন নাকি হাজী সাহেব?” মুখে হাসি।
“আরে না ভাই। আসছিলাম ছেলের জন্য সাইকেল কিনতে। ছেলে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। বড় ভাল ফল করেছে। তাই ভাবলাম একটা সাইকেল কিনে দেই। এমনে তো কিছুই চায় না..... আসেন ভেতরে একটু বসি।” মতিয়ার রহমানের কাঁধের হাত দিয়ে হাসলেন হাজী সাহেব।
“না ভাই। আজকে আর হবে না। অনেক কাজ পড়ে আছে। তারওপর বাহিরে ছোট ভাই আর ক্যাশিয়ার সাহেবও আছে। অপেক্ষা করতেছে আমার জন্য। আজকে আর বসা হবে না। তাঁর আগে বলেন সাইকেল কিনা হইছে আপনার?”
“নাহ, পছন্দই তো করতে পারলাম না।” হতাশ গলায় বললেন হাজী সাহেব, “আওনে আপনার ভাই আর ক্যাশিয়ার সাহেবকে ডাকেন তো, আমার বজরায় আসে খালি মুখে যাওয়া- তা হবে না। ডাকেন ডাকেন।”
মতিয়ার রহমান খানিক হা-না করে পরে ডাকলেন ওদের। ওপরে এনে পরিচয় করিয়ে দিলেন, “এনায়েত, ইনি হলেন আমার খুব ভাল বন্ধু মানুষ, হাজী খামিরুদ্দিন। বিশাল জমিদার বলতে পারো। উত্তরের প্রেসিডেন্ট তো ইনিই। পঞ্চগড়ে এক নামে সবাই চিনে......। হাজী সাহেব, এ হল আমার ছোট ভাই এনায়েত রহমান। আর উনি হলেন আমাদের হিসাব রক্ষক ফযর আলী।”
সালাম আর কুশলাদি বিনিময়ের পর্ব শেষে হাজী সাহেব ভেতরের একটা কামড়ায় এনে বসালেন সবাইকে। রীতিমত রাজকীয় বেশে ভেতরটা সাজানো। দামী দামী জিনিষপত্রে ভরিয়ে ফেলেছেন ভেতরটা তিনি। এনায়েত রহমান একটু অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন।
এর মধ্যে হাজী সাহেব ডাক দিয়ে এক কর্মচারীকে বললেন, “মেহমানদের জন্য ভাল নাস্তা পানির এনতেজাম করো সুলেমান।” গলায় কর্তৃত্বের অটুট আস্থাভরা স্বর। মাথা ঝাঁকিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল ভৃত্যটি।
“তারপর বলেন ভাই, আপনাদের ব্যবসা বাণিজ্য কেমন চলতেছে? সব ঠিক মত চলতেছে তো?” হাজী সাহেব তাঁর আসনে হেলান দিয়ে বসলেন। বেলা পরে এসেছে বলে ভেতরে দামী হ্যাজাক জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে আগে ভাগেই। সেটার শোঁ শোঁ এক ঘেয়ে শব্দ কানে হাল্কা ভাবে আসছে বাহিরের হাটের শব্দ ছাপিয়ে।
“জী। আল্লাহ পাকের দয়ায় ভালই চলতেছে। আপনার দিনকাল কেমন যায় হাজী সাহেব?” মতিয়ার রহমান জিজ্ঞেস করলেন।
“আমার আর দিনকাল। কাজকর্ম একটু বেশী এই আর কি। আল্লাহর রহমতে খারাপ না। দায়িত্বটা একটু চাপে বসছে ঘাড়ের ওপর। কঠিন কাজ। দোয়া রাখবেন।”
সুলেমান মিয়া একটা একয়াট বড় ট্রে’তে করে অনেক পদের মিষ্ট আর ফল নিয়ে ঢুকল। সামনের একটা টেবিলে সব একে একে সাজিয়ে দিয়ে হাজী সাহেবের কলকেটা জ্বালিয়ে দিল। পাইপটা তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে আগের মত নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল যেভাবে এসেছিল।
“নেন ভাই, আমি গরীর মানুষ। যা পারছি তাই দিয়ে আপনাদের আপ্যায়ন করার চেষ্টা করলাম।” হাজী সাহেব বললেন।
মতিয়ার রহমান হা হা করে উঠলেন, “আরে কি বলেন আপনে! এইটা কোনো কথা বললেন? আমাদের সৌভাগ্য আপনার সাথে দেখা হইলো।”
এনায়েত রহমান কম কথা বলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “ভাই সাহেবের কি একটাই ছেলে?”
“নাহ। আরো আছে। আমার তো ভাই তিন বিবির সংসার। বড় ঘরে এই একটাই ছেলে, আর এক মেয়ে। মেজো ঘরে দুই মেয়ে। ছোটটার ঘরে একটা ছেলে শুধু। মেয়েগুলার বিয়ে হয়ে গেছে।” হুকোয় টান দিতে দিতে বললেন।
“ছেলের জন্য সাইকেল নিতে আসছেন? ছেলে আসে নাই?”
“নাহ। ছেলে তো জানেও না তারে সাইকেল কিনে দিবো। একটু চমক দিতে চাই ছেলেরে।” স্মিত হাসি হাসলেন হাজী সাহেব।
“ছেলের নাম কি আপনার?”
“ডি.এম. খায়রুল আনাম। দোস্ত মোহাব্বত খায়রুল আনাম।” ভেঙ্গে বললেন, “বড় মেধাবী ছাত্র। প্রথম বিভাগে পাস দিয়েছে ম্যাট্রিক পরীক্ষায়।” গর্ব করে বললেন তিনি।
“মাশাল্লাহ! এটা তো বড় খুশির খবর।” খেজুরের রসের পিঠায় কামড় দিয়ে বলে উঠলেন ফযর আলী, “পড়াশোনা করাটাও আল্লাহর একটা অশেষ নেয়ামত। সবাইকে দেন না। খাস বান্দাদের জন্য দেন কেবল।”
তাঁর কথায় বাকিরাও মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল।
“হাজী সাহবে কি সাইকেল কিনেই চলে যাবেন?” মতিয়ার রহমান ইতস্তত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যা ভাই। কাল সকালেই ইনশাল্লাহ রওয়ানা দিবো।”
“যদি কিছু মনে না করতেন সাহস করে একটা অনুরোধ করতাম হাজী সাহেব।” মতিয়ার রহমান বললেন।
“অবশ্যই, আপনি আমার বন্ধু মানুষ, বলে ফেলেন।” হা হা করে হেসে ফেললেন হাজী সাহেব। চেহারার ভারী গাম্ভীর্য খনিকের জন্য যেন সরল একটা মানুষের হাসিতে ঢাকা পড়ল। এনায়েত রহমান আর ফযর আলী সামান্য নড়ে চড়ে বসলেন। কাঁচা পাঁকা দাঁড়ির এই হাজী সাহেব ভদ্রলোক এতই রাশভারী ব্যক্তিত্বের মানুষ, এত বড় হাসিটাও তাদের জড়তা কাটাতে পারল না। বরং অজানা একয়াট সমীহে ভেতরটা আরো ভারী হল।
“আজকের রাতটা আমাদের বাড়ির মেহমানখানায় থাকলে বড় ভাগ্যবান মনে করতাম নিজেদের।” মতিয়ার রহমান সংকোচ ভরা গলায় বললেন।
হাজী সাহবের কাঁচা পাঁকা ভ্রুঁ যুগল একটু কুঞ্চিত হয়েই ঠিক হয়ে গেল, “এই তো চিন্তায় ফালায় দিলেন ভাই। আমি গিয়ে নানান ঝামেলায় ফেলে দিবো ভাবী সাহেবা আর আপনাদের। তারওপর জায়গাটাও তেমন চিনি না, বজরাটা রাখে গেলে কি না কি ঘটে.....”
“ওসব শুনবো না ভাই। একয়াট অনুরোধ করছি, রাখতেই হবে। আপনাকে আবার কখন পাই না পাই! বজরা নিয়া একদম ভাববেন না। আমার লোকজন আমাদের গুলার সাথে সাথে এটাকেও পাহারা দিবে। আপনে শুধু একবার হা বলেন ভাই।”
আবারও হেসে ফেললেন হাজী সাহেব, “আচ্ছা ঠিক আছে। যাবো।”
“তাহলে এখনি চলেন।” মতিয়ার রহমানের মুখে হাসি ফুটল।
“না- না! এখন না। এশারের নামঅ্যায়াট পড়ে তারপর যাওয়া যাবে।”
“ঠিক আছে। আমার ছোট ভাই আসে আপনাকে নিয়ে যাবে। এখন উঠি ভাই?” উঠে দাঁড়ালেন সবাই। হাত মেলালেন সবাই হাজী সাহেবের সাথে। আন্তরিক ভাবে হাজী সাহবে তাঁদের ডেক পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।
“আল্লাহ হাফেয। সাবধানে যাবেন।”
“আমার ভাই আসে আপনাকে নিয়া যাবে। আপনি একটুও ভাববেন না হাজী সাহবে।” সালাম দিয়ে চলে গেলেন মতিয়ার সাহবে। বাকি দুজন তাঁর পেছন অএছন হারিয়ে গেল হাটের বিপুল আলোক সমুদ্রের মাঝে। সন্ধ্যা নেমে গেছে। চারপাশে এখানে অন্দকার আর ঠান্ডা বাতাস।
হাজী সাহেব ফোঁস করে একয়াট নিঃশ্বাস ফেললেন, “সুলেমান?”
নিঃশব্দে তাঁর পেছনে এসে দাঁড়াল অনুগত ভৃত্যের মত সে।
“রাতে মেহমান হবো মতিয়ার সাহেবের বাড়িতে। খালি হাতে তো আর যাওয়া যায় না। হাটে গিয়া ভাল দেখে পাঁচ-ছয়টা বড় রুই মাছ আর মুরগী নিয়া আসো। লাউ পাইলে সেটাও আনবা। মিষ্টি দু... নাহ, চাইর কেজি আনবা। মতিয়ার সাহেবের বাচ্চাদের জন্য বাতাসাও নিয়া আসবা, পারবা না?”
মাথা কাঁত করল সুলেমান মিয়া। পারবে সে।
হাজী সাহেব টাকা বের করে দিল সুলেমান মিয়াকে। যাওয়ার সময় সুলেমানকে বললেন, “আসার বেলা ভাল দেখে একটা লুঙ্গি আর জামা কিনবা তোমার জন্য। তোমার জামাটা যে ছিঁড়ে গেছে- বলো না তো কিছুই। যাও এখন।” ভেতরের কামড়ায় চলে গেলেন তিনি।
বাহিরে সুলেমান মিয়া টাকা হাতে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। অনেক বাতাস এখানে, ঠান্ডা বাতাস। হাঁড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে তার। ঘুরে হাটা লাগালো। দেরি করা যাবে না। হাজী সাহেবের হুকুম পালন করতে হবে আগে।


মতিয়ার রহমান সাহেবের বড় বাড়ি। একতলা আধপাকা বাড়ি, ওপরে টিন শেড। সামনে একটা উঠান। বাড়ির একপাশ আবার দুইতলা করেছেন গেল বছর। কাঠের দুইতলা। ওখানে অবশ্য দুই রূম। মতিয়ার সাহেব মাঝে মাঝে ওখানে থাকেন। দ্বিতীয় বিবাহ করায় ছোট বৌইয়ের ঘরটা এখানেই। ছোট বৌয়ের এখনো বাচ্চা হয়নি। বড় বৌ থাকে নিচের তলায়। বাকি ছেলে মেয়েরাও ওখানেই থাকে। এনায়েত রহমান উঠানের অন্যপাশের তিন ঘরের বাড়িটায় থাকেন স্ত্রী এবং কন্যা তহমিনাকে নিয়ে। বাড়িটা উঠান ঘিরে প্রায় লাগোয়া একটা অন্যটার সাথে, বিচ্ছিন্ন নয়। রান্না এক চুলাতেই হয়। আলাদা নয়। বাড়ির অন্য অংশে থাকেন হিসাব রক্ষক ফযর আলী, মাওলানা নিয়াজ শেখ এবং বাড়ির যাবতীয় কাজ দেখা শোনা করা জয়নাল ব্যাপারী। মাওলানা সাহেব বিয়ে করেননি। বাকিরা বিয়ে করেছে, তবে এখানে থাকে না পরিবার। গ্রামে থাকে। বেশি দূরে না। বীরগঞ্জেই। সপ্তাহে প্রায় গিয়ে থেকে আসেন পরিবারের সাথে। মতিয়ার সাহেবের মায়ের বাড়ি বীরগঞ্জে, যার কারণে তাঁর ঘরে অন্যান্য কাজে মায়ের বাড়ির দিকের লোকেরাই বেশি। বাড়ির কামলা কাজেম আলীও বীরগঞ্জের মানুষ। বীরগঞ্জের দিকে প্রায়ই খরা দেখা দেয়, তাই লোকজন চলে আসে এদিকে।
মতিয়ার রহমান আজ এশারের আগেই অনেক বাজার সদাই করে ফিরে আসলেন। বাড়িতে ঢুকেই গলা উঁচিয়ে সবাইকে ডাকা শুরু করলেন, “ফাতেমা, জয়নাব? কাজেম আলী? রোকেয়া? কই সব? তাড়াতাড়ি আসো!”
তাঁর বড় স্ত্রীর নাম ফাতেমা। জয়নাব হল ছোট স্ত্রী। রোকেয়া হলেন এনায়েত রহমানের স্ত্রী। মতিয়ার সাহেবের ডাকে সবাই হন্ত দন্ত হয়ে ছুটে এলেন।
মাথায় কাপড় দিয়ে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন ফাতেমা, “কি হইছে? এত ডাকাডাকি করতেছেন যে আজ?”
“আজকে রাতে বাড়িতে মেহমান আসবে। উত্তরের প্রেসিডেন্ট, হাজী খামিরুদ্দিন। বিরাট নামী লোক। বাজার করে আনছি। খুব ভাল করে পাকশাক করবা। উনার যত্ন-আত্তির কুনো কমতি হয়েছে- আমি যেন না শুনি। মেহমান খান ভাল মত ঝাড়পোছ করে ঠিক করে রাখবা। এশারের পরেই এনায়েত যায়া তাঁরে নিয়ে আসবে। কাজেম আলী, হুকাতে নতুন করে গরম পানি লাগাও, সাথে দামী তামাক দিবা, জাফরানও। দাঁড়ায়া থাইকো না, যাও যাও- কাজে লাগে পড়ো!”
সাথে সাথে সারা বাড়িতে হূলস্থূল পড়ে গেল। বাড়ির ভেতরের মেয়েদের কানেও গেল খবটা। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি ঝুঁকি মারতে লাগল- সবাই কি করছে দেখছে উৎসুক ভাবে। মতিয়ার সাহেবের সাত মেয়ে, দুই ছেলে। ছেলে দুটো ছোট। মেয়েদের প্রায় সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। বাকি আছে তিন জন। সেই তিন জনের একজন হল তহমিনা বেগম, বর্তমানে এনায়েত রহমানের মেয়ে হিসেবে যে বড় হচ্ছে। বাকি দু মেয়ের থেকে বড় তহমিনা। ফাতেমা বেগম পাকের ঘর থেকে একটু পরেই তহমিনাকে ডাক দিলেন, “তহমিনা মা? একটু পাঁকের ঘরে আসো তো। রওশান আরা আর পেয়ারারেও ডাক দেও।”
সাথে সাথে মাথায় ওড়না চাপিয়ে খালি পায়ে উঠান পেড়িয়ে দৌড়ে চলে এল তিন মেয়ে রান্না ঘরে। রান্না ঘরটা মূল বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন। উঠানের একপাশে খড়ের ছাউনি দিয়ে মাটির অর্ধেক দেয়াল উঠিয়ে তৈরি করা। পেছনেই বিরাট একয়াট পুকুর। শান বাঁধানো ঘাট। অবশ্য রান্নাঘরের পাশেই টিউবওয়েল আছে। পুকুরটা কেবল গোসলের জন্য। মেয়েদের জন্য আলাদা ভাবে ঘাটে ঘাউনি আর বেড়া দিয়ে ঘাট করে দেয়া আছে পুকুরে।
ফাতেমা বেগম মাছ কোঁটায় ব্যস্ত। জয়নাব চুলা ধরাচ্ছেন। রোকেয়া মুরগী কাটছেন। ফাতেমা বেগম তহমিনাকে বললেন, “তুমি আমার সাথে একটু হাত লাগাও মা। মাছগুলা কাটে শাষ করি দুইজনে। রওশানারা তুমি পেয়ারাকে নিয়া সবজিগুলা কাটে ফেলো তো।”
তহমিনা ওড়ানাটা কোমরে প্যাঁচিয়ে বড় চাচীর পাশে বসে পড়ল নতুন একটা বটি নিয়ে। বড় বড় কাতল মাছ। দ্রুত আঁশ ছাড়িয়ে কেটে ফেলতে লাগল। বাকি দুজনও কাজে লেগে গেল। তহমিনা মাছ কুটতে কুটতে কুপির আলোয় বাকিদের দিকে তাকালো। সবাই ব্যস্ত। চুলা ধরিয়ে তাতে লাকড়ি ঠেসে দিচ্ছেন জয়নাব। তহমিনা ফাতেমা বেগমকে জিজ্ঞেস করল, “বড় মা, বাড়িতে কে আসবেন আজকে?”
মতিয়ার রহমানের এ স্ত্রীই তার গর্ভধারিণী মা, বড় চাচী না ডেকে তাই বড় মা ডাকে তহমিনা।
“তোমার বড় আব্বা তো বললেন উত্তরের প্রেসিডেন্ট আসবেন বাড়িতে। হাজী খামিরুদ্দিন সাহেব। বিরাট নামী মানুষ।”
“প্রেসিডেন্ট! তাইলে তো অনেক বড়লোক।” অবাক হল রওশান আরা।
“হু।” মাথা ঝাঁকালো পেয়ারা বেগম।
“তাড়াতাড়ি হাত চালাও তোমরা। এশারের ওয়াক্ত প্রায় হয়ে গেল। শেষে মেহমান চলে আসলে কেলেংকারী! রান্না আগে আগে শেষ করতে হবে।” তাগদা দিলেন ফাতেমা বেগম।
তহমিনা হেসে গুণগুণ করে হাল্কা গলায় গান গাইতে গাইতে মাছ কুটতে লাগল।
                  “মাঝি ফের আইলো না আর নৌকাডুবি যায়, 
                  একলা নাওয়ের মাঝে বধু থাকল নিরুপায়.......” 
ফাতেমা বেগম কিংবা অন্যরা বাধা দিল না তাকে। আহা, কত সুন্দর গানের গলাটা!
মতিয়ার সাহেব অবশ্য তেমন গান শোনা মানুষ না। রান্না ঘরের দিকে তাঁকে আসতে দেখেই তহমিনা গান থামিয়ে ফেলল। “কিরে বেটি, সবগুলা দেখি কাজে লাগে পড়ছো! ভাল, খুব ভাল। যেই ঘরে যাবা, ঘর আলো করে রাখবা আল্লায় দিলে।” উদার মুখে হাসলেন মতিয়ার সাহেব। ঘুরে চলে গেলেন টিউবওয়েলের দিকে। ওযু করতে লাগলেন। মাওলানা নিয়াজ শেখের কন্ঠে আযানের ধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে। বাড়ির উত্তর দিকে মসজিদটা। মতিয়ার সাহেবের দেয়া মসজিদ। এশারের আযানটা রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে বড় করুণ সুরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। হাজী সাহেবের আসার সময় হয়ে গেছে।


নতুন একটা পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে কাশ্মিরী শালটা কাঁধের এপাশে ফেললেন হাজী খামিরুদ্দিন। এশারের নামায বাজারের মসজিদে পড়েছেন একটু আগে। এখন বজরায় ফিরে নতুন ভাবে তৈরি হয়ে নিলেন মতিয়ার রহমানের বাড়িতে যাবার জন্য। পায়ে মোজা পরে চামড়ার কালো জুতা পরলেন। একয়াট চিরুনী নিয়ে দাঁড়ি আঁচড়াতে আঁচড়াতে ডাক দিলেন, “সুলেমান?”
দরজার পাশে নিঃশব্দে হাজির হল সুলেমান। গায়ে নতুন ফতুয়া আর লুঙ্গি, গলায় গামছা। চুলগুলো তেল দিয়ে আঁচড়ানো।
“সব বাজার করা হইছে ঠিক মত? বড় বাঁশের টুকরি কিনছো? জিনিস নিবা কীভাবে?” আয়নায় তাকিয়ে দাড়িতে চিরুনী চালাচ্ছেন হাজী সাহেব।
সুলেমান ঘাড় কাত করে চলে গেল। খানিক বাদে দেখা গেল বিশাল একটা নতুন বাঁশের টুকরিতে মাছ, মিষ্টির হাড়ি, বাতাসার হাড়ি সাজিয়ে নিয়েছে, ওপরে একটা গামছা দিয়ে ঢাকা। হাতে দুটো মুরগী ঝুলছে উল্টো ভাবে। কঁক কঁক করে যাচ্ছে।
“হুম। খুব ভাল কাজ করেছো। সাবাস বেটা।” সন্তুষ্টির ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন হাজী সাহেব। গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, “মানিক মিয়া, জহর আলী?”
সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হল ওরা দুজন।
“আমার অবর্তমানে বজরার প্রতি খেয়াল রাখবা। প্রয়োজনে ঘুমাবা না। নিজের জিনিস, হেফাজতে রাখবা- বুঝলা? কোনো দরকার পরলে আমাকে খবর পাঠাবা। খালি রাখে যাবা না কোথাও।” গম্ভীর গলায় বললেন।
মাথা কাত করল, “জী আচ্ছা হুজুর।”
“তোমরা আমার বিশ্বস্ত লোক। তাই অন্যের হাতে ছাড়ে যাইতে ভরসা পাইনা। তোমরা থাকো এখানে। আল্লাহ তাআলা মালিক, আসল হেফাযতকারী তো তিনিই।” কাঠের ছড়িটা হাতে নিয়ে মেঝেতে বার দুয়েক ঠুকলেন। সুলেমানের দিকে তাকালেন, “চল সুলেমান, এনায়েত রহমানের আসার সময় হয়ে গেল....”
কথাটা শেষ হবার আগেই বাহির থেকে এনায়েত রহমানের ডাক শোনা গেল, “আসসালামুয়ালাইকুম, হাজী সাহেব আছেন নাকি?”
হাজী সাহেব দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলেন অন্ধকার খোলা আকাশের নিচে ডেকে, ভীষণ ঠান্ডা বাতাস, “ওয়ালাইকুম আসসালাম। এনায়েত সাহেব। পথে আসতে কোনো তকলিফ হয় নাই তো?...... সুলেমান, মই নামাও।”
নিচে হারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে আছেন এনায়েত রহমান। মই নামানো হল ঘাটে। “বিসমিল্লাহ্‌” বলে পা বাড়ালেন হাজী সাহেব। তাঁর পেছন পেছন সেই টুকরি হাতে নামতে লাগল সুলেমান।
ঘাটে নেমে এনায়েত রহমানের দিকে এগিয়ে এলেন, “ভাই সাহেবকে বড় যন্ত্রণায় ফেলে দিলাম মনে হয়।” হাসলেন।
এনায়েত সাহেবও প্রত্যুত্তরে হাসলেন, “আরে কি বলেন ভাই। এসব কিছু না। চলেন। বেশি দূরে না, বাজার থেকে যাবার পথে একটা গরু গাড়িতে উঠে যেতে হয় মাইল খানেক। চলেন, আল্লাহ পাকের নামে রওয়ানা দেই।” সুলেমানের হাতের বিশাল টুকরি আর মুরগী আগে খেয়াল করেননি। দেখা মাত্র জিভ কাটলেন, “আপনি এত সব কি করছেন ভাই! এত কষ্ট করতে গেলেন কেন? ভাইজান দেখলে রাগ করবেন অনেক!”
হা হা করে হাসলেন হাজী সাহেব, “মেহমান হতে যাইতেছি, খালি হাতে গেলে নিজের কাছেও খারাপ লাগে। এ তেমন কিছু না। চলেন, যাওয়া যাক।” বিড়বিড় করে দোয়া পড়লেন, “বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আ’লাল্লাহি লা হাওলা ওয়ালা ক্যুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ।”


মতিয়ার রহমান মেহমানদের জন্য ঘরের জিনিস পত্রের তদারকি করছিলেন। এমন সময় হাজী সাহেবরা এলেন। মতিয়ার রহমান ছোট ভাইয়ের গলার আওয়াজ পেয়েই বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে হারিকেন হাতে। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন বাড়ির গেটের দিকে। মাওলানা নিয়াজ শেখও তাঁর সঙ্গে এলেন। গেট খুলে দিতেই সালাম দিলেন, “আসসালামুয়ালাইকুম হাজী সাহেব, পথে আসতে কোনো অসুবিধা হয় নাই তো?”
“নাহ। একদম না। বরং গরুর গাড়িতে করে চড়ে আসতে খুব ভাল লাগছে। চারপাশে দেখি কুশারের বিছানো ক্ষেত। এত বড় কুশারের ক্ষেত তো খোলাপাড়াতেও করে না। সব আপনাদের নাকি ভাই?”
“এই আর কি, আল্লাহর রহমত।....... আসেন, ভেতরে আসেন ভাই।” হারিকেনের আলোয় পথ দেখালেন।


বাড়ির মেয়েরা রান্না শেষে ঘরে চলে গিয়েছিল। জানালার পর্দা সামান্য ফাঁক করে মেহমানদের দেখতে লাগল উঁকি ঝুঁকি মেরে। রান্নাঘরে তিন বৌ মাথায় ঘোমটা চাপিয়ে দ্রুত হাতে বাকি কাজগুলো শেষ করতে লাগলেন। মেহমানরা চলে এসেছে। এখন দেরি করলে মতিয়ার সাহেবের ধমক খেতে হবে।
মেহমানদের মেহমানখানায় বসানো হচ্ছে।
জানালা দিয়ে এক নজর তাকিয়ে রওশান আরা চাপা গলায় বলল, “বুবু দেখছো হাজী সাহেবরে? আজরাইল মার্কা চেহারা না? দেখলেই ভয় লাগে।”
তহমিনা মুখ টিপে হাসল, রওশান আরার মাথায় আলতো চাটি মেরে বলল, “চুপ থাক। বড় মা শুনলে মাইর খাবি।”
পেয়ারা পাকঘরের সামান্য কাজ করেই হয়রান হয়ে গেছে, বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পরেছে বাকি দুই ভাইয়ের সাথে। ঘরে একটা হারিকেন কম আলোতে জ্বলছে।
“ওমা! এরা দেখি নাখায়ে ঘুমায় পরছে বুবু! পেয়ারাটা ইকটু কাজ করলেই খালি ঘুমায়। বুড়ির বিয়ে যে ঘরে হবে ওই ঘরের তো কপাল খারাপ।”
“এতো কথা বলিস ক্যান? চুপ থাক!” ধমক দিল মৃদু স্বরে তহমিনা। পর্দার ফাঁক দিয়ে মেহমানদের দেখছে ও। এখন অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। ভেতরে সবাই। কাজেম আলীকে দেখা যাচ্ছে খাবারের গামলা, প্লেট, জগ হাতে দৌড়া দৌড়ি করছে। বড় আব্বা এবং তার বাবাও এদিক ওদিক ছোটা ছুটি করছেন ব্যস্ত ভাবে।
আপন মনেই বিড়বিড় করল তহমিনা, “কি এমন মেহমান! এত দৌড়ায় ক্যান সবাই?”
সারা জীবন অন্যদের ওপর হুকুম জারি করতে থাকা নিজের বড় আব্বা ও বাবাকে এভাবে ছোটাছুটি করতে দেখে অবাক হয় তহমিনা। হাজী খামিরুদ্দিন নামের কাঁচা-পাঁকা দাঁড়ির গুরু-গম্ভীর ঐ মানুষটাকে সে ঠিক বুঝতে পারেছে না। প্রেসিডেন্ট হলে হবে- তাতে এমন কি? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল তহমিনা বেগম।
প্রশ্নটার জবাব পেতে তহমিনা বেগমের অনেক বছর সময় লেগে গিয়েছিল।


রাতে খাওয়া শেষে নিজেদের স্ত্রীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন মতিয়ার এবং এনায়েত সাহেব। পরিচয়টা চেহারা দেখা দেখির মত করে হল না। তাঁরা লম্বা ঘোমটা দিয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন, সেখান থেকেই হাজী সাহেবকে সালাম দেয়া ও কুশলাদী জিজ্ঞেসের মাধ্যমে পরিচয় পর্বের শেষ হল। কার পরিবারে কে কে আছে- জানা হল একে অন্যের। সাদা মাটা পরিচয় শেষে হাজী সাহেবদের শোবার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন সবাই। হাজী সাহেবের থাকার ব্যবস্থা করা হল মূল মেহমান খানায়। সুলেমান থাকবে তাঁর পাশের ঘরের একটা বিছানায়। দু ঘরেই হারিকেনের ব্যবস্থা করা হল। মেহমান খানার বারান্দায় খাটিয়া পেতে ঘুমাবে কাজেম আলী। যদি রাতে মেহমানদের কোনো প্রয়োজন পরে, তাকে ডাকলেই হবে। মশারি টানিয়ে সব ঠিকঠাক করে দিয়ে মতিয়ার সাহেবের নিজের বিছানায় আসতে আসতে রাত হয়ে গেল অনেক।
আজ তাঁর বড় বৌ, ফাতেমা বেগম স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। স্বামীর আগে স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়লে স্বামীর অমঙ্গল হয়। তাই দীর্ঘ দিনের অভ্যাস মত আজ এত ক্লান্তির পরও জেগে রয়েছেন। পানের বাটা হাতে পান বানিয়ে দিলেন মতিয়ার রহমানকে। মতিয়ার সাহেব পানটা মুখে গুজে পাঞ্জাবী, পাজামা পালটে লুঙ্গি, গেঞ্জি পরলেন।
“রান্না বান্না সব ঠিক মত হইছে তো? হাজী সাহেব তো দেখলাম রান্নার খুব প্রশংসা করলেন।” মসারির ভেতরে বললেন স্বামীকে।
মতিয়ার সাহেব দুটো বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বললেন, “নাহ। রান্না মাশাআল্লাহ ভালই করছো। হাজী সাহেবের মনে থাকবে বহুদিন। যাগ্যা, সকাল বেলা ভাল করে পিঠা বানায়ো তো। খেজুরের রস দিয়া।”
“অভয় দিলে একয়াট কথা জিজ্ঞাস করবো?”
“বল, এত অনুমতির কি আছে?”
“হঠাৎ হাজী সাহেবকে এই ভাবে দাওয়াত দিয়া আনলা, এত খাতিরদারি.... ক্যান?”
“বুঝবানা। বুঝলে তো তুমিই মতিয়ার রহমান হয়া যাইতা।”
“বুঝায় বলেন। তাহলেই বুঝবো।”
“এখনো বলার সময় আসে নাই। সময় হলে সব জানবা।......... ভাল কথা, তহমিনা কোথায়?”
“ঘুমাইছে। রওশানের সাথে জয়নাবের ঘরে ঘুমাইছে আজ।”
“ও।”
“কেন? দরকার তারে?”
“নাহ।..... মাদ্রাসায় যায় ঠিক মত?”
“হু, যায়। পড়াশোনায় মাশাল্লাহ। পড়াইলে অনেক দূর যাবে সে।” গর্ব করে বললেন গর্ভধারিণী।
“এনায়েত কি তহমিনার বিবাহ নিয়া কিছু ভাবছে? রোকেয়ার সাথে এ বিষয়ে কোনো আলাপের আভাস পাইছো?” দুহাত মাথার পেছনে দিয়ে স্ত্রীর দিকে কাতালেন।
একটা নিঃশ্বাস ফেললেন ফাতেমা, “নাহ। এ বিষয়ে আমার সাথে রোকেয়ার কোনো কথা হয় না। সে নিজেও বলে নাই আমাকে।”
“ও।” গম্ভীর হয়ে গেলেন মতিয়ার সাহেব। ভেতরে সংশয় কাজ করে তাঁর। তহমিনার বিয়ের ব্যাপারে কি তাঁর আগ্রহ দেখানো উচিত হবে? পিতা তো এখন তিনি নন, তাঁর ছোট ভাই। যা দিয়েছেন, তাতে পিছুটান হটানো কঠিন। উজার করে দিয়েও আঁকড়ে পড়ে আছেন। কেমন যেন একটা কার্পণ্য ভেতরটায় এপিঠ ওপিঠ কুঁড়ে খাচ্ছে। অধিকারের পাট চুকিয়ে ফের অধিকারের রাশ ধরতে পারেন না তিনি, গত তেরটি বছরে নিজের ভেতরেই বেঁধে ফেলেছেন তহমিনা থেকে নিজেকে। মাঝে মাঝে বাঁধন খোলার বড় সাধ জাগে। পরক্ষণেই অজানা শংকায় হাত গুটিয়ে নেন।
শুয়ে পড়লেন পাশ ফিরে। ফাতেমা বেগমকে বললেন, “হারিকেনের আলোটা কমায় দেও। শুয়ে পড়ো। আর কত রাত জাগবা? সকালে অনেক কাজ তোমার। শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দেও।”
পানের বাটা রেখে হারিকেনের সলতে কমিয়ে দিলেন ফাতেমা। শুয়ে পড়লেন স্বামীর পাশে। মানুষটা অন্যপাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। আহারে, এপাশ ফিরে ঘুমালে অন্ধকারে অল্প হলেও তো মুখটা দেখতে পেতাম। এতো কাছাকাছি মানুষটা হঠাৎ কেন এতো বড় দূরত্ব তৈরি করলেন? সবই তো ছিল। তাও কেন দূরের মানুষ হয়ে গেলেন?
এই সংসারে জয়নাবের আগমনটা আজও মেনে নিতে পারেননি ফাতেমা বেগম। মতিয়ার রহমান তাঁর বুকের ভেতর যে ক্ষত সৃষ্টি করেছেন, সে ঘাঁ এই জনমে তাঁর শুকাবে না।
আধো অন্ধকারে, হারিকেনের মিটমিটে আলোয় এক ফোঁটা হীরার মত অশ্রু গড়িয়ে বালিশে পড়ল ফাতেমা বেগমের চোখ থেকে। এত কাছে থেকেও মতিয়ার সাহেব টের পেলেন না। উনি ঘুমাচ্ছেন।(চলবে) লেখকঃ মোঃ ফরহাদ চৌধুরী শিহাব

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন